Tuesday, September 16, 2014

জরথুশত্রবাদী ধর্মের ইতিহাস

পারস্য। বর্তমান ইরানের প্রাচীন নাম ছিল পারস্য। জরথুশত্র নামে এক ধর্মপ্রচারক প্রাচীন পারস্যে একটি ধর্ম প্রচার করেছিলেন। ধর্মটি জরথুশত্রবাদ বা Zoroastrianism নামে পরিচিত। ধর্মটির মূল স্বরূপ একেশ্বরবাদী। উপাস্যের নাম আহুর মাজদা। জরথুশত্রর রচনাবলী আভেস্তা বা জেন্দ আভেস্তা-যা জরথুশত্রবাদ-এর প্রধান ধর্মগ্রন্থ। জেন্দ আভেস্তায় জরথুশত্রর লেখা স্তোত্রগীত রয়েছে। এই স্তোত্রগীত কে বলা হয়- গাথা। জরথুশত্রবাদের ওপর ইতিহাসজুড়ে নানা রকম আঘাত আসায় আভেস্তার ভগ্নাংশমাত্র টিকে রয়েছে।
আজও জরথুশত্রর সময়কাল নিয়ে ঐতিহাসিকগণ একমত হতে পারেননি। কারও মতে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০; কারও মতে খ্রিস্টপূর্ব ৬০০। তবে পণ্ডিতেরা একমত যে জরথুশত্রর জন্মস্থান ছিল পারস্যের পূর্বাঞ্চলে (বর্তমান আফগানিস্তান) এবং পারস্যে ঐতিহ্যবাহী ধর্মের সংস্কার করে আহুর মাজদার উপাসনা প্রচলন করেছিলেন। আহুর মাজদা ছিলেন প্রজ্ঞার অধিপতি। প্রজ্ঞার পাশাপাশি থাকে অশুভ অন্ধকার- এমন এক ধারণাও প্রচার করেছিলেন জরথুশত্র।
আকামেনিয় শাসনামলে পারস্য (খ্রিস্টপূর্ব ৫৫৯ থেকে ৩৩০)
পারস্যে আকামেনিয় (Achaemenids) বংশ বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। সে সময়ই পারস্যে জরথুশত্রবাদ বিকাশ লাভ করেছিল। সম্রাট দারিয়ুস (খ্রিস্টপূর্ব ৫২২-৪৮৬) এবং সম্রাট জেরেক্সেস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৬-৪৬৫) জরথুশত্রবাদ কে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেছিলেন। পারস্যের ঐতিহ্যবাহী পারসিক পুরোহিত যাদের Magi বলা হয়; তাদের সঙ্গে জরথুশত্রবাদী ধর্মের ঠিক কি সম্পর্ক ছিল -সেটি আজও পণ্ডিতদের কাছে পরিস্কার না। (আমরা জানি তিনজন ম্যাজাই যিশুর জন্মের সময় ফিলিস্তিনে যিশুকে দেখতে গিয়েছিলেন। যিশু সেমেটিকভাষী সভ্যতার পয়গম্বর । অন্যদিকে ম্যাজাইগণ পারসিক অর্থাৎ আর্য। এই বিষয়টিও আজও রহস্যই থেকে গেছে।
এ আলোচনার শুরুতে বলেছিলাম, জরথুশত্রবাদের ওপর ইতিহাসজুড়ে নানা রকম আঘাত আসায় আভেস্তার ভগ্নাংশমাত্র টিকে রয়েছে। ধর্মটির ওপর প্রথম আঘাত হেনেছিলেন গ্রিক সম্রাট আলেকজান্দার (খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৬-৩২৩); এরপর জরথুশত্রবাদ ঠিক বিলীন না হলেও তার পূর্বগৌরব আর বজায় থাকেনি। যা হোক, ২২৪-৬৩৬ খ্রিস্টাব্দ অবধি পারস্যের রাজদণ্ডটি সাসানীয়গণের (Sassanids) হাতে ছিল। ওই সময়টায় জরথুশত্রবাদীদের উপাস্য আহুর মাজদার নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় ‘ওরমাজদ’। আর যে অশুভ শক্তি তাঁর বিরোধীতা করে তার নাম হয় -আহরিমান। (কাজেই জরথুশত্র এর মূল ধারণায় আহরিমান ছিল কিনা বলা যায় না)।
৬৩৫ খ্রিস্টাব্দে পারস্যে আরব অভিযান সম্পন্ন হয় । পারস্যের অধিকাংশ জনগনই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। নগন্য সংখ্যক পারস্যবাদী কেবল পূর্বপুরুষের ধর্মটি আঁকড়ে ধরে রাখে। বর্তমানে অবশ্য প্রায় ২৫,০০০ জরথুশত্রবাদী ইরানে বাস করে। এরা Gabars নামে পরিচিত। এরা থাকে প্রত্যন্ত ইয়াজদ এবং কেরমান শহরে।
একাদশ শতকে জরথুশত্রবাদীরা পারস্য থেকে ভারতবর্ষের পশ্চিম উপকূলে গুজরাটে অবতরণ করতে থাকে। গুজরাটের স্থানীয় অধিবাসীরা ওই ইরানি অভিভাসীদের বলত “পারসি”। (পারস্যের ভাষা ফার্সি থেকে শব্দটির উদ্ভব মনে হয় কিংবা তারা পারস্য থেকে এসেছিল বলে এই নাম।)
পারসিরা ভারতে এসে প্রথম কয়েক শতক কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত ছিল। উনিশ শতকে, অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসনের সময় তারা ব্যবসা এবং শিক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা রাখে। এবং ক্রমশ ভারতীয় সমাজে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। ওই উনিশ শতকেই পারসিরা ভারত ছেড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নানা উপনিবেশে বসতি স্থাপন করতে থাকে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পারসি লন্ডন ও টরেন্টোতে বাস করত।
জরথুশত্রের ভাব দর্শন
জরথুশত্রবাদী ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা জরথুশত্র। … ইনি বলতেন, জীবন হল ভালোমন্দের মধ্যে নিরন্তর এক যুদ্ধক্ষেত্র। আরও বলতেন, প্রত্যেক মানুষকে মৃত্যুর পরে শেষ বিচারের মুখোমুখি হতে হবে ।
জরথুশত্রবাদী উপাসনার মূলে আহুর মাজদা। মহান আহুর মাজদাশাশ্বত; কেউ নির্মাণ করেনি এবং তাঁর সাতজন স্বর্গীয় সেবক-সহচর রয়েছে। এই সেবক-সহচরদের প্রধান এক পবিত্র আত্মা; তাঁর নাম স্পেনটা মাইনয়ু। আহুর মাজদার বিপরীত অশুভ শক্তি হল আহরিমান। জরথুশত্র মনে করতেন … আমি আগেই বলেছি, জগৎ হল দুটি পরস্পর বিরোধী শক্তির যুদ্ধক্ষেত্র। স্বর্গীয় সাতজন সেবক-সহচর সত্যপথে থাকার পথটি বেছে নিলেও আহরিমান এবং দেভাস (অশুভ দেবতা) বেছে নিয়েছে মিথ্যাকে । মানুষকেও বলা হল সত্য কিংবা মিথ্যে পুণ্য কিংবা পাপ বেছে নিতে। জরথুশত্র আরও বলতেন, ভবিষ্যতে সময়ের শেষে (অ্যাট দ্য এন্ড অব টাইম) এক চূড়ান্ত যুদ্ধ হবে ; ওই যুদ্ধে প্রজ্ঞার অধিপতি আহুর মাজদা অশুভ আহরিমানকে চিরতরে পরাজিত করবেন।
জরথুশত্র আরও বলতেন, মৃত্যুর পর মানুষের বিচার হবে। তাদের একটি অতল খাদের ওপর দিয়ে এক সেতুর ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে হবে। নারী কিংবা পুরুষ সেতু পার হয়ে আহরু মাজদার নৈকট্য লাভ করতে পারবে। মৃত ব্যক্তির জন্য জন্য সেতুটি প্রশস্ত। যদি সে পুণ্যবান হয়। মৃত ব্যাক্তি যদি জীবনে মিথ্যেকে আশ্রয় করে তবে তার কাছে সেতুটি নেহাত সংকীর্ণ মনে হবে। সে অতল খাদে (নরকে?) পড়ে যাবে।
আগুন ছিল জরথুশত্রের কাছে বিশুদ্ধ পদার্থ। যে কারণে জরথুশত্রবাদীরা আজও অগ্নি উপাসনা করেন। যে কোনো জরথুশত্রবাদী উপাসনালয় বস্তুত একটি অগ্নি উপাসনালয় মাত্র। সে অগ্নি উপাসনালয়ে ধাতুর তৈরি বড় একটি পাত্রে নিরন্তর আগুন জ্বলে। দিনে পাঁচবার পুরোহিত আগুনে জ্বালানি দেন। আভেস্তা থেকে পাঠ করেন পবিত্র স্তোত্রগীত। পানিও জরথুশত্রবাদীদের কাছে পবিত্র পদার্থ। বিশুদ্ধতার জন্য জরথুশত্রবাদীরা দৈনিক গোছল করে। অর্থাৎ গোছল ধর্মীয় আচারের অন্তর্গত। আর প্রতিদিন প্রার্থনার জন্য পাঁচটি সময় নির্ধারিত রয়েছে। জরথুশত্রবাদীদের নববর্ষের নাম ‘নওরোজ’ বা নতুন দিন। বসন্তে মহা ধূমধাম করে এই পরব উযযাপন করা হয়।
জরথুশত্রবাদের কৃত্য
সাত বছর বয়েসে পারসি ছেলেমেয়েরা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্প্রদায়ের সদস্য হয়। ইরানের Gabars দের অবশ্য এই বয়েস দশ । এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নাম নাভজোৎ বা নবজন্ম। এই অনুষ্ঠানে তারা একটি সাদা জামা ও পবিত্র সুতা পায়। ওই জামা ও সুতা নতুন সদস্যদের বাকি জীবন পরে থাকতে হয়।
নির্জনতার স্তম্ভ
জরথুশত্রবাদীদের একটি ধর্মীয় কৃত্য সবার দৃষ্টি আকর্ষন করে। সেটি হল শেষকৃত্য। জরথুশত্র বিশ্বাস করতেন … চারটি উপাদানকে দুষিতকরা উচিত নয়। এই চারটি উপাদান হল আগুন মাটি বাতাস ও পানি। কাজেই কোনও মৃত জরথুশত্রবাদীকে মাটিতে সমাহিত করা হয় না কিংবা আগুনে পোড়ানো ওহয় না। তার বদলে বিশেষ ভাবে নির্মিত স্তম্ভে মৃতদেহটি ফেলে রাখে। সে স্তম্ভটিকে বলে নির্জনতার স্তম্ভ বা towers of silence । এখানে দ্রুত শকুনেরা মড়ার মাংসল অংশ খেয়ে ফেলে। সূর্যালোকে শুকিয়ে যায় হাড়। তখন হাড়গুলো জড়ো করে একটি হাড়দানিতে (Ossuary ) রাখা হয়। তবে বর্তমানে জরথুশত্রবাদী শেষকৃত্য একটি সমস্যা হয়ে উঠেছে। কেননা বিশ্বে জরথুশত্রবাদী সম্প্রদায় যেখানে বাস করে তার কাছেপিঠে নির্জনতার স্তম্ভ নির্মান করা সম্ভব নয়। কাজেই ঐতিহ্য রক্ষা করা হচ্ছে না। তারা এখন মড়া পুড়িয়ে ফেলছেন। কেউ-বা বৈদ্যুতিক ক্রিমেশন (cremation) ব্যবহার করছেন।
জরথুশত্রবাদী সম্প্রদায়ে পুরোহিতের ছেলেই পুরোহিত হয়। বাবাই ছেলেকে বিশেষ শিক্ষা দেয়। তাকে বিশেষ বিশেষ ধর্মীয় কৃত্য সম্পন্ন করতে হয়। জরথুশত্রবাদী ধর্মটি গ্রহন করা যায় না। অর্থাৎ এ ধর্মটি বৌদ্ধ খ্রিস্টান এবং ইসলামের মতো proselytizing ধর্ম নয়। কাজেই জরথুশত্রবাদী ধর্মসম্প্রদায়টি কোনও অ-জরথুশত্রবাদীকে তাদের সম্প্রদায়ে গ্রহণ করে না। আমি আগেই একবার বলেছি যে পারসিরা একাদশ শতকে ভারতবর্ষে থাকা শুরু করেছিল। সে সময় তারা তৎকালীন কর্তৃপক্ষের অনুমতি প্রার্থনা করেছিল। সে সময় তাদের বলতে হয়েছিল যে তারা কোনো ভারতবাসীকে জরথুশত্রবাদী ধর্মে ধর্মান্তরিত করবে না।

No comments:

Post a Comment

thank you