Sunday, September 21, 2014

ইজতিহাদ : গুরুত্ব, হুকুম, ক্ষেত্র ও শর্তসমূহ

ইজতিহাদ : গুরুত্ব, হুকুম, ক্ষেত্র শর্তসমূহ
. আব্দুল্লাহ ফারুক সালাফী
ভূমিকা: ইসলাম মহান আল্লাহর একমাত্র মনোনীত দীন, যা পৃথিবীতে সর্বপ্রথম সর্বশেষ দীন। যা শাশ্বত, সার্বজনীন মানব জাতির জন্য পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। আর মহান দীনকে প্রাণবন্ত, গতিশীল এবং সর্বযুগে স্থানের জন্য সামঞ্জস্যশীল করতে ইসলামে ইজতিহাদের গুরুত্ব অপরিহার্যতা অপরিসীম।
ইজতিহাদের গুরুত্ব : বিশ্ব যতই অগ্রসরমান, আধুনিক উন্নত হোক না কেন এবং সেখানে যতই নিত্য নতুন সমস্যা প্রয়োজনীয়তা দেখা যাক না কেন, ইসলাম তার সব কিছুর সাথে পূর্ণমাত্রায় সামঞ্জস্যশীল। মানব জীবনের গতিময়তা প্রবাহমানতার সাথে ইসলাম পুরোপুরি ফিট। আর তাই এর উপযুক্ততা সমকালীন যুগ জিজ্ঞাসার জবাব দানে সামর্থ্যের পিছনে ইজতিহাদের অনন্য ভূমিকা রয়েছে। কেননা কোন একটা বিষয় যতই আধুনিক হোক না কেন তার দিকে একটা সূক্ষ্ম ইশারা কুরআন হাদীসে থাকেই, যা বুঝবার জন্য কিতাব সুন্নাহর জ্ঞানে পারদর্শী হতে হয়। সুতরাং নির্দ্বিধায় বলা যায়, ইজতিহাদ কিতাব সুন্নাহ্রই একটা অংশ। ফলে তাকে শরীয়তের একটা স্বতন্ত্র দলীল হিসেবে উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন। আর কারণেই মহানবী (সা) বলেন, আমি তোমাদের মাঝে রেখে গেলাম টি বিষয় অর্থাৎ শরীয়তের ২টি উৎস।
ইজতিহাদের শাব্দিক বিশ্লেষণ : ইজতিহাদ শব্দটির মূল جهد  ধাতু হতে উদ্গত মাসদার বা ক্রিয়ামূল। যার শাব্দিক অর্থ কোন বিষয়ে চুড়ান্ত প্রয়াস বা যথাসাধ্য সর্বাত্তক প্রচেষ্টা। ইসলামী পরিভাষায় মুজতাহিদ কর্তৃক শরীয়তের কোন নির্দেশ সম্পর্কে সুষ্ঠু কোন জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে সর্বাঙ্গীন চেষ্টা সাধনার নাম ইজতিহাদ।
ইজতিহাদের শরয়ী বৈধতার দলীল: 
ইসলামী চিন্তাবিদগণ আল-কুরআনুল কারীমের কিছু আয়াত নবী (সা) হতে বর্ণিত কিছু হাদীসকে ইজতিহাদের শরঈ বৈধতার দলীল হিসেবে পেশ করে থাকেন। যেমন :
إِنَّا أَنزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللّهُ وَلاَ تَكُن لِّلْخَآئِنِينَ خَصِيمًا
নিশ্চয়ই আমি তোমার প্রতি সত্যসহ গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি যেন তুমি তদনুযায়ী মানবদের মাঝে বিচার-ফায়সালা করতে পার। যা আল্লাহ তোমাকে শিক্ষা দান করেছেন এবং তুমি বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষে বিতর্ককারী হয়ো না।” (সূরা নিসা ১০৫)
ইমাম ইবনু কাসীর (রহ) বলেন, অত্র আয়াতেকারীমাকে ফিকাহ শাস্ত্রবিদগণ দলিল হিসাবে পেশ করে থাকেন যে, নবী (সা) এর যে ইজতিহাদ করার বৈধতা ছিল তা আয়াত দ্বারা প্রমাণিত (তাফসীরুল কুরআন আল আযীম ৬০৬ পৃষ্ঠা প্রথম খণ্ড)
وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِّكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً وَبُشْرَى لِلْمُسْلِمِينَ
আমি আত্মসমর্পণকারীদের জন্যে প্রত্যেক বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরূপ, পথ নির্দেশ, দয়া সুসংবাদস্বরূপ তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছি।” (সূরা নাহাল ৮৯)
এছাড়াও মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর পবিত্র গ্রন্থে অনেক স্থানে চিন্তা বিবেককে কাজে লাগাতে বা প্রয়োগ করতে বলেছেন। সুতরাং যারা ইসলামী শরীয়তের আহকাম তথা মাসআলা-মাসায়েল বের করার কাজে ব্রতী হবেন তারা নিজের চিন্তা বিবেককে কাজে লাগাতে বা প্রয়োগ করতে বলেছেন। সুতরাং যারা ইসলামী শরীয়তের আহ্কাম তথা মাসআলা মাসায়েল বের করার কাজে ব্রতী হবেন তারা নিজের চিন্তা বিবেক বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে ইসলামী আহকাম উদ্ভাবন করবেন। ইজতিহাদের বৈধতার দলীল হিসেবে মুআয বিন জবাল (রা) এর নবী (সা) এর সম্মুখে কৃত উক্তি- اجتهد برأي অর্থাৎ আমি আমার বিবেক দ্বারা ইজতিহাদ করব। অত্র হাদীসটি মুরসাল (কেননা মুআয (রা:) এর নীচের বর্ণনাকারীগণ অজ্ঞাত) হওয়ায় দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও উম্মতের অনেকেই সেটা গ্রহণ করেছেন।
তাছাড়া সহীহ বুখারী শরীফের সেই বিখ্যাত হাদীস যেখানে নবী (সা) স্পষ্টভাবে বলেছেন যে,
إِذَا حَكَمَ الحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ، وَإِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَخْطَأَ فَلَهُ أَجْرٌ
বিচারক যদি ইজতিহাদ করেন এবং নিজ ইজতিহাদ সঠিকভাবে সম্পাদন করতে পারেন তবে তার দ্বিগুণ নেকী। আর যদি বিচারক তার ইজতিহাদে ভুলও করেন তবুও তার জন্য একগুণ নেকী।
মহানবী (সা) স্বয়ং আল-কুরআন থেকে ইজতিহাদ করে অনেক বিষয়ে সমাধান প্রদান করতেন তা সহজেই অনুমেয়। কেননা অসংখ্য হাদীস কুরআনেরই কাছাকাছি অর্থ বহন করে। তবে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, নবী (সা) হতে যদি কখনও ইজতেহাদে ভুল হয়ে থাকে- তৎক্ষণাৎ মহান আল্লাহ ওয়াহীর মাধ্যমে তাঁকে সংশোধন করে দিয়েছেন।
নবী (সা) যে অনেক সময় ইজতিহাদ করে সমাধান প্রদান করতেন। তার সবচেয়ে বিশুদ্ধ অকাট্য প্রমাণ সহীহাইন তথা বুখারী মুসলিমে বর্ণিত হাদীস- যেখানে তিনি বলেছেন যে, আমি তো কেবল একজন মানুষ। আমি শোনার ভিত্তিতেই ফায়সালা দিয়ে থাকি। সুনানে আবু দাউদে এই হাদীসটিই আরো স্পষ্ট ভাবে বর্ণিত হয়েছে যে,
إِنِّي إِنَّمَا أَقْضِي بَيْنَكُمْ بِرَأْيِي فِيمَا لَمْ يُنْزَلْ عَلَيَّ فِيهِ
অর্থাৎআমার নিকট যে, বিষয়ে কুরআনের কিছু নাযিল হয়নি আমি তো সে ক্ষেত্রে কেবল আমার ইজতিহাদ দ্বারা তোমাদের উভয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত প্রদান করব।” (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৩৫৮৫)
অনেক ইসলামী চিন্তাবিদের মতে যেগুলো পার্থিব বিষয়, সে সমস্ত বিষয়াদিতে তিনি ইজতিহাদ বা রায়ের আশ্রয় নিতেন কিন্তু যে বিষয়গুলো ইসলামী শরীয়তের অংশ, সেগুলো পুরোটাই ওয়াহীভিত্তিক তিনি সিদ্ধান্ত প্রদান করতেন। আর অভিমতটিই সঠিক।
আসহাবুর রায় তথা রায়পন্থীদের জন্য অত্র হাদীসে কোন সুসংবাদ নেই। কেননা নবী (সা) স্পষ্টভাবেই বলেছেন, যে বিষয়ে কুরআনের কিছু নাযিল হয়নি আমি তো সে ক্ষেত্রে কেবল আমার ইজতিহাদ দ্বারা তোমাদের উভয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত প্রদান করব। সুতরাং কুরআন সুন্নাহ না পাওয়া পর্যন্ত রায় কিয়াস বা ইজতিহাদের উপর ভিত্তি করে আমল করা যাবে। কিন্তু দলীল পাওয়া মাত্রই সেগুলোর কার্যকারিতা বাতিল বলে গণ্য হবে। যেমন ইমাম শাফেঈ (রহ) তার বিখ্যাত গ্রন্থ আর রিসালাহতে বলেন: যতক্ষণ দলীল অবর্তমান শুধু ততক্ষণই কিয়াস আমলযোগ্য যেমনভাবে পানির অবর্তমানে মাটি দ্বারা তায়াম্মুম বৈধ।
ইজতিহাদের হুকুম : ইজতিহাদ কখনও ফরযে আইন, কখনও ফরযে কিফায়া, কখনও বা মুস্তাহাব, আবার কখনো বৈধ এবং কখনও হারাম। ইজতিহাদ ফরযে আইন হবে যখন অন্য কোন ইজতিহাদকারী বা মুজতাহিদ বিদ্যমান থাকবে না  তখন সে মুহূর্তেই মুজতাহিদকে ইজতিহাদকার্য সম্পাদন করতে হবে।
ইমাম মালেক (রহ) এর মতে ইজতিহাদ ওয়াজিব যেমন তাকলীদ বর্জনও ওয়াজিব।
যখন অন্যান্য মুজতাহিদগণ থাকবেন তখন কোন একজন মুজতাহিদের পক্ষে ইজতিহাদ করা ফরযে কিফায়ার পর্যায়ভুক্ত হবে। কিন্তু কেউই যদি ইজতিহাদ না করেন, তবে সকল মুজতাহিদগণ পাপী গুনাহগার হবেন।
ইজতিহাদ যখন সাধারণ অবস্থায় করা হবে যে, মুসলিম উম্মাহর তা প্রয়োজন মেটাবে, তারা শরীয়তের বিধান দ্বারা উপকৃত হবে, সে অবস্থায় ইজতিহাদ করা মুস্তাহাব তথা উত্তম হবে।
আর এমন বিষয়ে ইজতিহাদ যা এখনও সংঘঠিত হয়নি সে বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হওয়া সত্ত্বেও ইজতিহাদ করা না করা উভয়টা বৈধ।
ইজতিহাদের ক্ষেত্র: ফকীহ ইসলামের নীতি নির্ধারণে বিশ্লেষণকারীগণ ইজতিহাদের ক্ষেত্র নির্ধারণ করেছেন যে, যেখানে ইসলামী শরীয়তের অকাট্য দলীল বিদ্যমান নেই শুধুমাত্র সেখানেই ইজতিহাদ প্রয়োজন। সুতরাং পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের আবশ্যকতা, অনুরূপ সিয়াম, যাকাত হাজ্জের আবশ্যকতার ব্যাপারে কোন ইজতিহাদ চলবে না। যেমন মদ, যিনা-ব্যভিচার, চুরি-ডাকাতি নিষিদ্ধ হবার ব্যাপারে কোন ইজতিহাদ চলবে না কেননা সেগুলি বির্তকমুক্ত ইসলামী শরীয়তের অকাট্য দলীলাদি দ্বারা প্রমাণিত।
কিন্তু যেখানে মূলত কোন নাস তথা দলীলই নেই অথবা দলীল আছে কিন্তু তা অকাট্য অখণ্ডনীয় নয় সে সব স্থানগুলো হচ্ছে ইজতিহাদের ক্ষেত্র বা ময়দান।
ইজতিহাদের শর্তসমূহ : ইজতিহাদ যেহেতু ইসলামী শরীয়তের সর্বোচ্চ স্তরের একটি পর্যায়, সুতরাং সকলের জন্য ইজতিহাদ প্রযোজ্য নয়। যোগ্যতাগুলি অর্জন করতে হয়:
১। ইলমুত তাফসীর তার উসূল তথা নীতিমালা ২। ইলমুল হাদীস তার উসূল তথা নীতিমালা ৩। ইলমুল ফিক্হ তার নীতিমালা ৪। ইলমুর রিজাল তথা আসমায়ে রিজাল শাস্ত্রের ইলম ৫। ইলমুদ দিরায়াহ তথা পূর্ণমাত্রায় হাদীস বুঝে সেখান হতে কি কি মাসায়েল আহকাম উদ্ভাবন করা যায় সংক্রান্ত জ্ঞান, ৬। আরবী ভাষা সাহিত্যের জ্ঞান ৭। আদালত তথা নির্ভরযোগ্য, মুত্তাকী আমানতদার হওয়া। ৮। মাকাসিদুশ শারীয়াহ তথা ইসলামী শরীয়তের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সংক্রান্ত জ্ঞান থাকা। উপরোক্ত ৮টি মৌলিক গুণাবলী যা একজন মুজতাহিদের মাঝে থাকতেই হবে।
যৌথ ইজতিহাদ : ইসলামী শরীয়তের অনেক ইবাদত কাজ একাকী বা এককভাবে করা উত্তম হলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে তা যৌথ বা দলবদ্ধ ভাবে করা উত্তম। আর যে সমস্ত কাজ যৌথভাবে করা উত্তম তন্মধ্যে ইজতিহাদ অন্যতম। আর সে কারণেই মহান কাজটি উমার ইবনুল খাত্তাব, আব্দুল্লাহ বিন মসজিদ যাইদ বিন সাবিত (রা) যৌথভাবে করতেন পরস্পরে একে অন্যকে জিজ্ঞেস করতেন যেমন কাজটি আলী বিন আবু তালিব, উবাই বিন কাব আবু মূসা আশআরী (রা:) করতেন। (ইলামুল মু-অক্কেয়ীন ১২/) অথচ তারা প্রত্যেকে ইলমের পাহাড় বা জাহাজ ছিলেন।
ইজতিহাদ মূলত একটি শুরাভিত্তিক অত্যন্ত সূক্ষè স্পর্শকাতর বিষয়। এককভাবে তা করার চেয়ে যৌথভাবে করলে নিঃসন্দেহে তা নির্ভুল বেশি সঠিক হবার সম্ভাবনা থাকে।
কারণেই উমার বিন আব্দুল আযীয (রহ) মদীনায় একটি ফকীহগণের বোর্ড গঠন করেছিলেন।
ব্যাপারে নবী (সা) হতে একটি চমৎকার হাদীস বর্ণিত হয়েছে যা আলী (রা) বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমাদের সামনে যদি এমন বিষয় উপস্থিত হয়, যে ব্যাপারে কুরআনের কোন নির্দেশনা নেই। এমনকি আপনার সুন্নাহও আমাদের সামনে নেই। সে মুহূর্তে আমরা কী করতে পারি? জবাবে নবী (সা) ইরশাদ করেন, সে বিষয়ে তোমরা আলেম-ওলামাগণকে অথবা মুমিনগণের মধ্যে হতে আবেদগণকে একত্রিত কর অতঃপর সকলে সে বিষয়ে পরামর্শ সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর। আর কারো একক মত গ্রহণ করে তোমরা সিদ্ধান্ত দিওনা।
ইজতিহাদ যতদিন দলবদ্ধ বা যৌথভাবে হতো ততো দিন তার অবস্থাও ভাল ছিল। কিন্তু যখন এককভাবে ইজতিহাদ শুরু হয়ে গেল তখনই তার অবস্থা শোচনীয় হয়ে গেল। তাছাড়া বর্তমান ৩য় মিলিনিয়াম তথা সহস্রাব্দে যখন অসংখ্য আধুনিক নতুন নতুন সমস্যা অপর দিকে যখন ইলমের দৈন্যতা দুর্ভিক্ষ, তা ছাড়া ঈমান বিক্রেতা বিভিন্ন পন্থীর আবির্ভাব যখন প্রবল অপ্রতিরোধ্য তখন তো প্রেক্ষাপটে ইজতিহাদ যৌথভাবে হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।
তাছাড়া দলবদ্ধ যৌথভাবে ইজতিহাদ পরিচালিত হলে উম্মাহর ঐক্য সংহতি আরো বেশি কার্যকর শক্তিশালী হবে ইনশাআল্লাহ


ইসলাম ধর্মে যুগোপযোগী ইজতিহাদ প্রয়োজন
সমস্যার সমাধানে সর্বাঙ্গীণ প্রচেষ্টার নাম হচ্ছে ইজতিহাদ ইসলামী পরিভাষায় শরিয়তের কোনো নির্দেশ সম্পর্কে সুষ্ঠু জ্ঞান বা সমাধান লাভের উদ্দেশ্যে সর্বাঙ্গীণ প্রচেষ্টা বা সাধনার নাম ইজতিহাদ পবিত্র কোরআনের অনেক আয়াতে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশাবলি রয়েছে পবিত্র কোরআন হচ্ছে জীবন দর্শন, আর জীবন দর্শন থেকে যুগোপযোগী জীবন বিধান প্রদান করেন নবী-রাসুলরা এবং পরবর্তীতে আল্লাহ রাসুল (সা.) কর্তৃক মনোনীত উলিল আমররা (:৫৯) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের পর পরই সাহাবাদের মধ্যে ইজতিহাদের প্রচলন শুরু হয় হজরত ওমর একশতেরও বেশি শরিয়তি আইন প্রবর্তন করেছেন, যা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জমানায় ছিল না পবিত্র কোরআনে ফরজ, ওয়াজিব এবং মোবাহ_তিন ধরনের নির্দেশাবলি বিদ্যমান যেমন_মোতা বিবাহ, একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করা এবং দাসপ্রথা ইত্যাদি মোবাহ বিধানের অন্তর্ভুক্ত এসব বিধানের অনুমতি প্রদান করা হয়েছিল তৎকালীন আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে হজরত ওমর (রা) বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে মোতা বিবাহ রদ করেছিলেন, যা পরবর্তী সময়ে সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃত হয়েছিল একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ব্যাপারে অনুমতি প্রদানের ক্ষেত্রে অন্যতম কারণটি ছিল যুদ্ধবিগ্রহে পুরুষের সংখ্যা হ্রাস পাওয়া এবং নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া নারীদের পুনর্বাসন সংস্থাপনের জন্য শর্তসাপেক্ষে পুরুষদের একাধিক বিয়ে করার অনুমতি প্রদান করা হয়েছিল, যার প্রয়োজন এখন আর নেই দাস প্রথাকে রাসুলুল্লাহ (সা.) নিরুৎসাহিত করেছিলেন ফলে দাস প্রথাও যুগের প্রয়োজনে স্বাভাবিকভাবে রহিত হয়ে গেছে
'
ইজতিহাদ' শব্দটি আরবি 'জাহদ' হতে উদ্ভূত এবং এতে সর্বাধিক পরিমাণে সর্বোত্তম সামর্থ্য অনুযায়ী প্রচেষ্টা চালানোকে বোঝায় কোরআন সুন্নাহ ইজতিহাদের মূল ভিত্তি ইজতিহাদের ফলাফল কোরআন সুন্নাহর মৌলিক আদর্শের পরিপন্থী হতে পারে না
রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর সুন্নাহর মাধ্যমে যে বিধানগুলো আমাদের দিয়েছেন, তা তৎকালীন সময়োপযোগী বিধান মূল ভাবধারাক ঠিক রেখে বিধানগুলো বর্তমান যুগোপযোগী হতে হবে এবং এটাই স্বাভাবিক হিজরির দ্বিতীয় শতকে আইয়ামে দ্বীনদের কর্তৃক ইজতিহাদের মাধ্যমে অনেক ইসলামী আইন প্রয়োগ করা হয়েছে, যেগুলোর ওপর আজ ধর্মের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ইজতিহাদ সেখানে থমকে দাঁড়িয়ে আছে অতঃপর ইজতিহাদের দ্বার রুদ্ধ করে দেওয়া হয় এবং সেই মধ্যযুগীয় ইজতিহাদের ওপরই এখনো আমাদের নির্ভর করতে হয় এবং বলা হয়ে থাকে বর্তমানে ইজতিহাদের আর কোনো প্রয়োজন নেই অথবা সে রকম যোগ্য ব্যক্তি আর কখনো আসা সম্ভব নয় কথাগুলো আহম্মকি ছাড়া অন্য কিছু নয় বর্তমান বিজ্ঞান প্রযুক্তির চরম উন্নতিক্ষণে এসেও যদি আমাদের ওই সাম্রাজ্যবাদী স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠীর অনুমোদিত মধ্যযুগীয় ফতোয়া বা ইজতিহাদের ওপর নির্ভর করে চলতে হয়, তা হলে ইসলামের জন্য সেটি হবে আত্মঘাতী . ইকবাল ইজতিহাদের পথকে রুদ্ধ করায় অত্যন্ত ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ইসলামের যুক্তিবাদী মতের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াই হলো ইজতিহাদের পতনের কারণ আধুনিক দৃষ্টিসম্পন্ন যুক্তিবাদীরা তাঁদের যুগোপযোগী চিন্তাধারা, মতামতের কারণে রক্ষণশীলদের মনে সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি করেছিলেন স্বৈরাচারী রাজশক্তি ইসলামী চিন্তাধারার নবজাগরণে শঙ্কিত ভীতসন্তস্ত্র হয়ে পড়লো তারা ইসলামের তথাকথিত পবিত্রতা অখণ্ডতাকে রক্ষার অজুহাত ইজতিহাদ সব ধরনের নতুনত্বের প্রবর্তনকে নাকচ এবং নিষিদ্ধ করে দেয় কাজটি করা হয় শরিয়ত রক্ষার দাবি নিয়ে চার মজহাবের কিছু দালালশ্রেণীর পণ্ডিত দ্বারা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এমন এক ব্যবহারিক ধর্মীয় রীতিনীতি প্রচলন করা হলো, যাতে তাদের অনৈসলামিকভাবে ক্ষমতা দখল রাজ্য পরিচালনায় কোনো বাধাপ্রাপ্ত না হয় মূলত চার মজহাবের সম্মানিত ইমানদাররা যুগের প্রয়োজনে ইজতিহাদ করেছিলেন সত্যি, তবে তাঁদের কেউ ব্যক্তিগত নামে মজহাব সৃষ্টি করে উম্মাহকে বিভক্তির বেড়াজালে আবদ্ধ করে যাননি পরবর্তী সময়ে তাঁদেরই কথিত আব্বাসীয় রাজশক্তির পদলেহনকারী কিছু শিষ্য পণ্ডিতব্যক্তি মাধ্যমে ইমামদের নামে মজহাব সৃষ্টি করে উম্মাহকে বিভিন্ন মজহাবে বিভক্ত করে স্বৈরাচারী রাজশক্তি উরারফব ধহফ জঁষব পলিসির বাস্তবায়ন করে এবং আইন করে পরে ইজতিহাদ বা গবেষণার কাজ রুদ্ধ করে দেওয়া হয় অনেকের মতে মধ্যযুগের পর ইসলামের ইজতিহাদের পথ বন্ধ হয়ে গেছে নতুন করে আর কোনো ইজতিহাদ বা গবেষণার প্রয়োজন সুযোগ নেই মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণা প্রবর্তিত বিধি-বিধানের ওপর কিয়ামত পর্যন্ত উম্মাহকে চলতে হবে ধরনের একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত মুসলিম উম্মাহকে আধুনিক যুগোপযোগী মুক্তচিন্তার ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত করে তোলে সুতরাং যুগের প্রয়োজনে জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়গুলোর আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ইজতিহাদ বা গবেষণার একান্ত প্রয়োজন অন্যথায় ইসলাম ধর্ম অন্য অনেক ধর্মের মতো তার ব্যবহারিক কার্যকারিতা হারিয়ে মুখথুবড়ে পড়বে এবং শুধু একটি নিছক আনুষ্ঠানিক ধর্মে পরিণত হবে পবিত্র কোরআন বলছে, তারা কী কোরআন নিয়ে চিন্তা করে না, নাকি তাদের অন্তরে পর্দা পড়ে গেছে
https://www.facebook.com/akla.pathik11

No comments:

Post a Comment

thank you